বাংলাদেশের মাতৃভাষাসমূহ ও কিছু প্রাসঙ্গিকতা




আমাদের এই পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষার খোঁজ পাওয়া যায়। এসব ভাষার অনেকগুলো আবার বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আবার অনেকগুলো বিলুপ্তির পথে। বড় বড় জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর বহুল ব্যবহারের কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ব্যবহৃত ভাষাগুলোই মূলত বিলুপ্তির শিকার হয়। এভাবেই এ পৃথিবী থেকে অনেক ভাষার বিলুপ্তি ঘটেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা হারিয়ে যাচ্ছে অধিক হারে। মূলত চর্চার অভাব এবং মূল ভাষা ও অপরাপর বিদেশী ভাষার প্রভাবে এসব আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।


পৃথিবীর প্রতিটি দেশে একাধিক ভাষা ব্যবহারের দেখা মিলে। উদাহরণ পেতে হলে আমাদের বেশি দূরে যাওয়া লাগবেনা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই রয়েছে অনেক জাতিসত্ত্বার বসবাস এবং জাতি ও অঞ্চল ভেদে এদের মাতৃভাষাও আলাদা। যেমন- বাংলা, অসমিয়া, গুজরাটি, মারাটি, উর্দু, হিন্দী ইত্যাদি। পৃথিবীতে এ ধরণের অনেক ভাষা রয়েছে যাদের মধ্যে অনেকগুলোর কথা আমরা জানি আবার অনেকগুলোর কথা জানিনা। উদাহরণ ¯^iƒc বলা যায়, সোয়াহিলি, মালয়লম, আলবেনীয়, উমরুল, ফার্সি, উর্দু, হিন্দী, ফিনিস, ইংরেজি, ক্যাটালন, আরবী, মালিংকে ইত্যাদি আরো অনেক ভাষার কথা।
দেশে দেশে ভাষার বিভিন্নতার উদাহরণের জন্য আমাদের দেশই যথেষ্ট, কারণ এখানে অনেক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং এদের সবার ভাষা আলাদা। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ হলো বাঙালী জাতি এবং এদের মাতৃভাষা হলো বাংলা। কিন্তু আমরা কেউ যদি বাংলাদেশীদের মাতৃভাষা বাংলা মনে করি তবে ভুলটা হবে সেখানেই, কারণ বাংলা বাঙালীদের মাতৃভাষা কিন্তু বাংলাদেশীদের নয়, এটি শুধুমাত্র এদেশের সবার আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার্য ভাষা। এ নিয়ে কোন প্রকার বির্তকের অবকাশ থাকতে পারে না। কারণ এদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০টির মতো আদিবাসী গোষ্ঠীর বসবাস। এসব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরী, রাখাইন, গারো, তংচইঙ্গা, খাসিয়া, মুরং, ম্রো, ওঁরাও, রাজবংশী, বম, খ্যাং, কোচ, হাজং, পাংখো, সাহাতো, গোথা, চাঁক, কেওট ইত্যাদি। এছাড়া আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা রয়েছে। এসব জাতিসত্ত্বার প্রায় প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা মাতৃভাষা রয়েছে। এই প্রবন্ধে বহুল পরিচিত কিছু আদিবাসী জাতিসত্ত্বার ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হলো।
এদেশের সর্ববৃহৎ আদিবাসীগোষ্ঠী হলো চাকমা সমপ্রদায়, আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অঞ্চলে। এদের ভাষার নাম চাকমাভাষা এবং নিজস্ব বর্ণমালা ও বর্ণলিপি রয়েছে। চাকমা ভাষায় লেখা অনেক প্রাচীন গল্প-কবিতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সিলেট ইত্যাদি অঞ্চলে ত্রিপুরা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এদেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা ‘ককবরোক’ নামে পরিচিত। এ ভাষার ৩৬টি উপভাষা আছে বলে জানা গেছে। D`vniY¯^iƒc, উসুই, নাইতং, ফাতংু ইত্যাদি উপভাষার নাম বলা যায়।
উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় ‘সাঁওতাল’ জনগোষ্ঠীর বসবাস। এদের ভাষা সাঁওতাল ভাষা নামে পরিচিত। ভারতের সাঁওতালীরা ‘অলচিকি’ নামের একটি লিপি ব্যবহার করে থাকলেও এদেশের সাঁওতালীদের নিজস্ব কোন লিপি নেই। এ ভাষায় ‘কারমেলি’ ও ‘মাহেলসে’ নামে দুটি উপভাষা আছে।
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসরত ‘তংচইঙ্গা’ সমপ্রদায়ের ভাষার নামও তংচইঙ্গা ভাষা। চাকমা জাতির মানুষেরা তংচইঙ্গাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত মনে করলেও তারা নিজেদের আলাদা জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তংচইঙ্গাদের নিজেদের ভাষায় গল্প-কবিতা লিখতে দেখা যায়।
 বাংলাদেশের আরেকটি অন্যতম ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা হলো ‘মনিপুরী’ সমপ্রদায়। এদের বসবাস মূলত সিলেট অঞ্চলে। এদের মূল ভাষার নাম মনিপুরী মৈতৈ। এদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। মনিপুরী সমপ্রদায়ের ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ ও ‘পাঙন’ নামে দু’টি শাখা আছে। বিষ্ণুপ্রিয়াদের ভাষা আবার খালাছাই নামে পরিচিত। এদের লিপি দেবনাগরী প্রভাবিত। অবশ্য মনিপুরীরা সুদীর্ঘকাল ধরে বাংলা লিপি ব্যবহার করে আসছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও বিরিশিরি ‘গারো’ সমপ্রদায়ের প্রধান আবাস ভূমি, এদের ভাষা গারো ভাষা নামে পরিচিত। গারো ভাষার কিছু প্রতিশব্দ হলো- আচিক, মান্দাই, মান্দিবোচিক, আন্দিকুটিক ইত্যাদি। এ ভাষায় রোমান হরফের প্রাধান্য দেখা যায়। রোমান হরফে গারো ভাষায় বাইবেল, গারো লোককাহিনী, গারো অভিধান ইত্যাদি রচিত ও অনূদিত হয়েছে। এ ভাষায় ৭টি উপভাষা আছে বলে জানা গেছে।
রাঙ্গামাটি, বান্দরবানে বসবাসরত ‘লুসাই’ জনগোষ্ঠীর ভাষার নাম দুলিত্যাপটং। এদেরকে লুসেই, কুকি, শিকাম, কুগি, লঙ্গি ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।  এদের ভাষায়ও রোমান হরফের প্রচলন দেখা যায়।
কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা ইত্যাদি অঞ্চলে ‘রাখাইন’ জাতির দেখা মিলে। এরা মায়ানমারের রাখাইন সমপ্রদায় ভুক্ত। এদের ভাষা রাখাইন ভাষা নামে পরিচিত এবং এদের নিজস্ব বর্ণলিপি রয়েছে, যা বর্মী বর্ণমালা নামে পরিচিত। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে রাখাইন ভাষা ইন্দো-মঙ্গোলিয় গোত্রভুক্ত সমৃদ্ধ ভাষা।
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি অঞ্চলে  বসবাসরত ‘মার্মা’ জনগোষ্ঠীর ভাষার নামও মার্মা ভাষা। এদের নিজস্ব লিপি আছে যা বর্মী লিপি দ্বারা প্রভাবিত। তবে কোন কোন ভাষাবিদের মতে রাখাইন, মার্মা, রামরে‌্য ও মরৌ ভাষা পরস্পর একই ভাষার উপভাষা।
রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসকারী ‘ওঁরাও’ জাতির ভাষার নাম কুরুখ। ময়মনসিংহের ‘হাজং’ জাতির ভাষা এসেছে মূলত বাংলা ও অসমিয়া ভাষা থেকে। যার কারণে এদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই। আবার পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে বসবাসরত ‘খুমি’ এবং কাপ্তাইয়ে বসবাসরত ‘খ্যাং’ নামক জাতি দুইটি কুকিচীন দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এদের ভাষাও ঐ দলের অন্তর্ভুক্ত। তবে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও উত্তরাঞ্চলের ‘কোচ’ সমপ্রদায়ের এক সময়ে নিজস্ব ভাষা থাকলেও কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এছাড়াও অনেক আদিবাসী জাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তবে একথা সত্যি, বর্তমানে পৃথিবীতে সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা নেই, আবার যাদের ছিল অযত্নে-অবহেলায়, অব্যবহার ও সংরক্ষণের অভাবে সেগুলোর অনেকগুলো হারিয়ে গেছে এবং বর্তমানেও অনেক ভাষা বিলুপ্তির পথে রয়েছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আদিবাসীদের অনেক বৈচিত্রময় ভাষা পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এর অন্যতম কারণ হলো, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা যেহেতু বাংলা এবং এর ব্যবহারও ব্যাপক এবং রাষ্ট্রীয় ও শিক্ষা গ্রহণসহ সকল ধরণের কর্মকান্ড এ ভাষায় সম্পাদিত হয় সেহেতু নিজ নিজ সমপ্রদায়ের মধ্যেও এসব ভাষার ব্যবহার কমে গেছে।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে আদিবাসীদের মাতৃভাষার কোন ¯^xK…wZ নেই। তাদের দীর্ঘদিনের এই দাবীটি বারবার উপেক্ষিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও আমাদের দেশে এসব ভাষা ও বর্ণলিপি সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা এখনো নেয়া হয়নি। দ্রুত এ বিষয়টি নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে হয়তো কোন একদিন এ দেশ তার আদিবাসীদের সমৃদ্ধশালী ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য হারাবে। সুতরাং নিজেদের ¯^v‡_©B আমাদেরকে এই ঐতিহ্যগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
আর এজন্য জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এসব ভাষার বর্ণমালা, বিভিন্ন প্রাচীন রচনা, শিলালিপি ইত্যাদি সংগ্রহ ও যথাযথ সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনে এগুলোর অনুলিপি বা রেপ্লিকা তৈরি করে বিভিন্ন সময়ে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আমাদের এসব ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা। এছাড়া এসব ভাষাকে রক্ষার প্রয়োজনে এদের চর্চার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে এবং বিশেষ করে শিক্ষা গ্রহণের প্রাথমিক স্তরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষণ ও চর্চার প্রয়োজনে আলাদা বা অন্য কোন এক বা একাধিক বিষয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি আদিবাসী ও বাঙালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধন আরো সুদৃঢ় করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তরে বাংলা, ইতিহাসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আদিবাসীদের সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, বিবর্তনের ধারা ইত্যাদি নিয়ে নানাবিধ রচনা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আশা করি আমাদের দেশের সরকার এ বিষয়ে কার্যকর নজর দিবেন। এছাড়া নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের লক্ষে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে সবচেয়ে বেশি। মহান মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা ও বিভাগীয় শহর গুলোতে নানা উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে আদিবাসী ভাষাগুলোকে সবার সামনে উপস্থাপনের মাধ্যমে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ও উল্লেকযোগ্য ভুমিকা রাখতে হবে এবং তাদের পাশাপাশি আমাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা এমন একটি জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দান করেছে। আমাদের সেই বীর সেনানীদের কীর্তির কারণে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ¯^xK…wZ পেয়েছে, বাংলা ঠাঁই পেয়েছে আন্তর্জাতিক ভাষার তালিকায়, সারা বিশ্বে গর্বিত হয়েছে বাঙালী জাতি। আমাদের চাইতে মাতৃভাষার গুরুত্ব আর কারাইবা ভালো বুঝবে? একটি গর্বিত জাতি হিসেবে আমাদের উচিত সবার ভাষার প্রতি সমান গুরুত্ব দেয়া। আমাদের দেশের সকল ঐতিহ্যকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আমার বিশ্বাস আন্তরিকভাবে চাইলে আমরা সফলকাম হবো।

Comments