জমিদার রবীন্দ্রনাথ ও উন্নয়ন ভাবনা




রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী। এক সময়কার জমিদার এই মানুষটি নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের শত কোটি মানুষের মাঝে শত বছর ধরে আসন নিয়ে আছেন। বাংলা ও বাঙালী জাতিকে বিশ্বের দরবারে সফলভাবে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান নিয়ে গেছেন সবার উপরে, ’বিশ্বকবি’ ও ’কবিগুরু’ উপাধিও পেয়েছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণাকর্ম সাধিত হচ্ছে, চর্চা করা হচ্ছে তাঁর অমর কীর্তিগুলোকে। কিন্তু এই অমর মানুষটি কি শুধুমাত্র  কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, গল্প ইত্যাদি লিখে গেছেন ? নাকি এগুলোর পাশাপাশি ¯^‡`k চিন্তা, দেশের ও মানুষের উন্নয়ন ভাবনা এবং তার বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গেছেন ?  আমাদের দেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁর গান, কবিতা, গল্প যতটা চর্চা করে , জানে ততটা কিন্তু তাঁর সমাজ চিন্তা ও কর্মকান্ডের কথা জানে না, অথচ কবিগুরুর অন্যতম এই দিকটি উন্মোচিত হয়েছিল এই দেশের মাটির স্পর্শেই। তিনি যে অকৃত্রিম ভালবাসা আর আন্তরিক মমতায় বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে ¯^‡`k ও মানুষের উন্নয়ন ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, প্রগতির পথ দেখিয়েছিলেন সেই মমতায় আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তার কাছেই বারবার ফিরে যেতে হবে, কারণ এই সময়ে সেগুলো প্রাসঙ্গিকতা তো হারায়নি বরং অনেকাংশে আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।


মূলতঃ জমিদারি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হবার পর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হয়ে উঠেন। যেসময়ে জমিদাররা প্রজাদের শোষণ করে, তাদের সুযোগ-সুবিধা, উন্নয়নের কথা না ভেবে জোরপূর্বক খাজনা আদায় আর ভোগ বিলাস-প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তারের দিকে নজর দিয়েছিলেন সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ, প্রজা প্রেমিক জমিদার। জমিদারি দেখার পাশাপাশি তিনি যেমন সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন তেমনি প্রজাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছিলেন। প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমবায় পদ্ধতিতে একতাবদ্ধ কাজের ক্ষেত্র তৈরি , কৃষির উন্নয়ন, ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মনস্ক  শিক্ষিত জাতি তৈরিসহ ¯^‡`‡ki উন্নয়নের কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন।

জমিদারির পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব নেয়ার আগে রবিঠাকুর তাঁর পিতার নিদের্শে ১৮৯১ সাল থেকে প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে জমিদারি দেখাশুনা করেছিলেন এবং সেই সময় তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো হিন্দু- মুসলমান সবাইকে এক সঙ্গে পাশাপাশি কাছারি ঘরে বসালেন, যা আগে কখনো ঘটেনি। তিনি তাঁর কাছারি থেকে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা আলাদা হুকো প্রথা বাতিল করেন। তিনি সবসময় দেশের মানুষদের একতাবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করে গেছেন।

জমিদার রবীন্দ্রনাথ সবসময় প্রজা অনুরাগী ছিলেন। সবসময় তাদের কি করলে ভালো হবে তাই চাইতেন। তাঁর আরেকটি অন্যতম কাজ ছিল ১৮৯৫ সালে কুষ্টিয়ায় ’ট্যাগোর এন্ড কোং’ নামক একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। সরাসরি বিপননে অক্ষম চাষী বা উৎপাদনকারীদেরকে মধ্যসত্ত্বভোগী মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা করে তাদের ন্যায়সঙ্গত (ন্যায্য) পণ্যমূল্য পাওয়ার e¨e¯’v¯^iƒc তাদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিশেষ করে ধান ও পাঠ কিনে বাজারজাত করার দায়িত্ব নিয়েছিল এই কোম্পানি। জমিদার রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যা ছিল সে সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটেও আমাদের কৃষক-চাষীদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে রবি ঠাকুরের এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগটি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে।

শিক্ষানবিশকালীনই তিনি বাংলার মাটির আসল ¯^v` পেয়ে যান। বাংলার রূপ যেমন তাঁকে মুগ্ধ করেছিল তেমনি প্রজাদের দুঃখ ব্যথিত করেছিল। তাঁর সহজ-সরল মন তাঁকে প্রজাদের কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। আর এই কারনেই হয়তো তিনি প্রজা প্রেমিক জমিদার হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৯৬ সালে তাঁকে তাঁদের সমগ্র জমিদারি দেখাশুনার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব প্রদান করা হয়। জমিদার থাকাকালীন সময়ে তিনি গ্রাম বাংলার আসল রূপ, প্রজাদেও জীবনব্যবস্থা প্রত্যক্ষরূপে অবলোকন করেন। তিনি কখনো একা, কখনো সপরিবারে পতিসর,শাহজাদপুর, শিলাইদহ ইত্যাদি স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, থেকেছেন। এ বাংলায় তার বিশাল একটি সময় কেটেছে নদীর উপরে বজরায়(নৌকা)। তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্য্য যেমন হৃদয়স্থ করেছিলেন তেমনি প্রজাদের সুখ-দুঃখে ভাবিত হয়েছিলেন, তাদের উন্নতির কথা ভেবেছেন, উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের। তিনি প্রজাদের দারিদ্রতাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং তা থেকে উত্তোরণের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন। দেশে-বিদেশের নানা জায়গায় ঘুরে তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা তিনি গ্রাম বাংলার উন্নয়নে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। এমনও হয়েছে যখন তিনি কোন দেশে গেছেন তখন তিনি ঐ দেশের কৃষি ব্যবস্থা, দারিদ্র নিরসনের কার্যক্রমসমূহ ¯^P‡¶ দেখার চেষ্টা করতেন এবং দেশের প্রেক্ষাপটের সাথে তা মিলিয়ে কিভাবে কাজ করা যায় সেটার জন্য সচেষ্ট হতেন।

তিনি সবার সম্মিলিত কাজের উপর জোর দিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। তিনি মনে করতেন, অনৈক্যই দারিদ্রতার প্রধানতম কারণ, তাই সবাই একতাবদ্ধ হলে দারিদ্র নিরসন সম্ভব। এজন্য তিনি তার লেখায় ও কাজে ঐক্যের কথা বলেছিলেন। তাঁর সমবায় নীতিতে তিনি বলেছেন,  “এটা তো দেখা গেছে, ছেলেবেলায় একলা পড়িলে ভুতের ভয় হইত। বস্তুত এই ভুতের ভয়টা একলা মানুষের নিজের দুর্বলতাকেই ভয়। আমাদের বারো আনা ভয় এই ভুতের ভয়। সেটার গোড়াকার কথা এই যে, আমরা মিলি নাই, আমরা ছাড়া-ছাড়া হইয়া আছি। ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যাইবে, দারিদ্র্যের ভয়টাও এই ভুতের ভয়, এটা কাটিয়া যায় যদি আমরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইতে পারি। বিদ্যা বলো, টাকা বলো, প্রতাপ বলো, ধর্ম বলো, মানুষ যা কিছু দামি এবং বড়ো, তাহা মানুষ দল বাধিঁয়াই পাইয়াছে। বালি-জমিতে ফসল হয় না, কেননা তাহা আটাঁ বাঁধে না; তাই তাহাতে রস জমে না, ফাঁক দিয়া সব গলিয়া যায়। তাই সেই জমির দারিদ্র্য ঘোচাইতে হইলে তাহাতে পলিমাটি পাতা-পচা প্রভৃতি এমন কিছু যোগ করিতে হইবে যাহাতে তাহার ফাঁক বোজে, তার আঁটা হয়, মানুষের ঠিক তাই; তাঁদের মধ্যে ফাঁক বেশি হইলে তাদের শক্তি কাজে লাগে না, থাকিয়াও না থাকার মতো হয়।” (সমবায়-১, রবীন্দ্র রচনাবলী , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩১৩)

আয়ারল্যান্ড, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় দারিদ্র বিমোচন এবং অর্থোপার্জনে সমতা অর্জনের লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ সমবায় ভাবনায় ব্যাপকভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তার লেখায় ও কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি লিখেছেন , “আজ কিছুকাল থেকে মানুষ অর্থনীতির ক্ষেত্রেও এই সত্যকে আবিস্কার করেছে। সেই নতুন আবিস্কারের নাম হচ্ছে সমবায়-প্রণালীতে ধন-উপার্জন। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, অতিকায় ধনের শক্তি বহুকায় বিভক্ত হ’য়ে ক্রমে অন্তর্ধান হবে এমন দিন এসেছে। আর্থিক অসাম্যের উপদ্রব থেকে মানুষ মুক্তি পাবে মার-কাট করে নয়, খন্ড খন্ড শক্তির মধ্যে ঐক্যের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হ'য়ে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে মানবনীতির স্থান ছিল না বলেই এত অশান্তি ছিল সেখানে সেই মানব সত্যের আবির্ভাব হচ্ছে। একদা দুর্বল জীব প্রবল জীবের রাজ্যে জয়ী হয়েছে, আজও দুর্বল হবে জয়ী প্রবলকে মেরে নয়, নিজের শক্তিকে ঐক্য দ্বারা প্রবলরূপে সত্য ক'রে।” (সমবায়নীতি, রর , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩২২) ... “জনসাধারণ যদি নিজের অর্জনশক্তিকে একত্র মেলাবার উদ্যোগ করে তবে এই কথাটা স্পষ্ট দেখিয়ে দিতে পারে যে, যে মূলধনের মূল সকলের মধ্যে, তার মূল ব্যক্তি-বিশেষের মূলধনের চেয়ে অসীমগুণে বেশি।” (সমবায়-২, রর, চতুর্দশ খন্ড, পৃ-৩১৮)।

আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত নিজেদের সম্মিলিত শক্তির কথা মনে রাখে না, দারিদ্র বিমোচনে ও নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডে কোন কোন ক্ষেত্রে বারংবার টাকা বা অর্থের অভাবের কথা, কপালের দোষ ইত্যাদি দিয়ে থাকে। সমবায়-১ এ তাই তিনি পুর্নবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কথা বলেছেন।  ” সকল দেশেই গরিব বেশি, ধনী  কম। তাই যদি হয় তবে কোন দেশকে বিশেষ করিয়া গরিব বলিব। এ কথার জবাব এই, যে দেশে গরিবের পক্ষে রোজগার করিবার উপায় অল্প, রাস্তা বন্ধ। যে দেশে গরিব ধনী হইবার ভরসা রাখে সে দেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত ধন। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে, এ কথা বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের দেশে ভরসার অভাব। তাই, যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি তখন কপালের দোষ দিই; বিধাতা কিংবা মানুষ যদি বাহির হইতে দয়া করেন তবেই আমরা রক্ষা পাইব, এই বলিয়া ধুলার উপর আধমরা হইয়া পড়িয়া থাকি। আমাদের নিজের হাতে যে কোন উপায় আছে, এ কথা ভাবতেও পারি না।
এই জন্যেই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার, হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া। মানুষ না খাইয়া মরিবে- শিক্ষার অভাবে, অবস্থার গতিকে হীন হইয়া থাকিবে, এটা কখনোই ভাগ্যের দোষ নয়, অনেক স্থলেই এটা নিজের অপরাধ। দুর্দশার হাত হইতে উদ্ধারের কোন পথই নাই, এমন মানিবার ধর্ম নয়। মানুষ যেখানে আপনার সেই ধর্ম ভুলিয়াছে সেইখানেই সে আপনার দুর্দশাকে চিরদিনের সামগ্রী করিয়া রাখিয়াছে। যদি কোনো দেশে এমন দেখা যায় যে সেখানে দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষ অচল হইয়া পড়িয়া দৈবের পথ তাকাইয়া আছে তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, মানুষ সে দেশে মানুষের হিসাবে খাটো হইয়া গেছে।
মানুষ খাটো হয় কোথায় যেখানে সে দশজনের সঙ্গে ভাল করিয়া মিলিতে পাবে না। পরস্পরের মিলিয়া যে মানুষ সেই মানুষই পুরা, একলা-মানুষ টুকরা মাত্র। ” (সমবায়-১, রর , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩১৩)

বর্তমান সময়ে একশ্রেণীর ধনী মানুষেরা গরিবদের শোষন করে ধনকে নিজেদের ভোগ বিলাসে পরিণত করেছে। রবীন্দ্রনাথ তার সময়েও এ পরিস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন। ধনী গরিবের বৈষম্যের পাশাপাশি নগর গ্রামের পার্থক্যও তার চোখে পড়েছিল। তার মতে, “পূর্বে যে- অর্থ সাধারণের কার্যে ব্যয়িত হইত, এখন তাহা ব্যক্তি ভোগে ব্যয়িত হইতেছে। ইহাতে ফল হইতেছে দেশের ভোগ বিলাসের স্থানগুলি সমৃদ্ধশালী হইয়া  উঠিতেছে, শহরগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে, কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই।” (সমাজ, রর , ষষ্ঠ খন্ড, পৃ ৫২৯)
তিনি আরো বলেছেন, “ পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজে একটা জায়গাই বাধা ঘটে। সে হচ্ছে অর্থোপার্জনের কাজে। এখানে মানুষের লোভ তার সামাজিক শুভবুদ্ধিকে ছাড়িয়ে চলে যায়। ধনে বা শক্তিতে অন্যের চেয়ে আমি বড় হব, এই কথা যেখানেই মানুষ বলেছে সেইখানেই মানুষ নিজেকে আঘাত করেছে।” (সমবায়-২, রর , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩১৭)

বৃহত্তর জনগোষ্ঠির অবস্থার উন্নয়নের জন্য তিনি তাদের সবার প্রতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন ,  “সাধারণের-দারিদ্র্য হরণের শক্তি ধনীর ধনে নেই। সে আছে সাধারণের শক্তির মধ্যেই। এই কথাটা জানা চাই, এবং তার দৃষ্টান্ত সকলের কাছে সুস্পষ্ট হওয়া চাই । ”(সমবায়-২, রর, চতুর্দশ খন্ড, পৃ-৩১৮)।

দারিদ্রকে দমিয়ে রাখতে না পারলে যে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয় তা রবীন্দ্রনাথের ভালভাবে জানা ছিল। তাই তিনি ¯^‡`‡ki মানুষকে নিজের শক্তিকে চিনতে ও জানতে এবং আত্নশক্তিতে বলীয়ান হতে বলেছেন। “ দারিদ্র থেকে রক্ষা না পেলে আমরা সকল-রকম যমদূতের হাতে মার খেতে থাকব। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ধন নিহীত হয়ে আছে, এ সহজ কথাটি বুঝলে এবং কাজে খাটালে তবেই আমরা দারিদ্র থেকে বাঁচব।”(সমবায়-২, রর , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩১৮)

দারিদ্র থেকে মুক্তির জন্য তিনি সবাইকে শিক্ষিত কেও গড়ে তোলা, পল্লী সংগঠন গড়ার উপর জোর দিয়েছেন। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাক্রমে জীবনমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। তার ‘ পল্লী প্রকৃতি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না অগ্নি দেয়।”
তিনি আরো বলেছেন,  “দেশের সমস্ত গ্রামকে সাধনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কতকগুলি পল্লী নিয়ে এক একটি মণ্ডলী স্থাপন করা দরকার, সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের ও অভাব মোচনের ব্যবস্থা করে মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করে তুলতে পারে তবেই ¯^vqZ¡kvm‡bi চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য  হয়ে উঠবে। নিজের পাঠশালা, শিল্প, শিক্ষালয়, ধর্মগোলা সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাংক স্থাপনের জন্য পল্লীবাসীদের শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে। এমনি ক’রে পল্লীগুলি আত্মনির্ভরশীল ও বূহ্যবদ্ধ হয়ে উঠলেই আমরা রক্ষা পাব।” (সমবায়-২,রর, পৃ. ৩১৯)। ‘আমাদের মূলধন অল্প। সুতরাং সেটা খাটাবার জন্য আমাদের বিহিত রকমের শিক্ষা ও ধৈর্য্য চাই’ (পল্লীপ্রকৃতি, রর, পৃ. ৩৫৪)।

তিনি অন্তত একটি পল্লী গ্রামকে হলেও আত্ম নির্ভরশীল করে তোলার ¯^cœ দেখেছিলেন, যেটি সমগ্র দেশের জন্য আদর্শ গ্রাম হয়ে থাকবে। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষেরা অংশ গ্রহণ করুক।  ‘ পল্লীর উন্নতি’ নামক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন , “আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের যেখানে হোক একটি গ্রাম আমরা হাতে নিয়ে তাকে আত্মশাসনের শক্তিতে সম্পূর্ন উদ্‌বোধিত করে তুলি । সে গ্রামের রাস্তাঘাট, তার ঘরবাড়ি পরিপাট্য, তার পাঠশালা, তার সাহিত্যচর্চা ও আমোদপ্রমোদ, তার রোগীপরিচর্যা ও চিকিৎসা, তার বিবাদনিষ্পত্তি প্রভৃতি সমস্ত কার্যভার  সুবিহিত নিয়মে গ্রামবাসীদের দ্বারা সাধন করাবার উদ্যোগ আমরা করি ।” (রবীন্দ্রনাথ, পল্লীর উন্নতি, রর, চতুর্দশ খন্ড, পৃষ্ঠা. ৩৫৮ ) 

তিনি বিশ্বাস করতেন পল্লীর উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পল্লী জনগোষ্ঠির মানোন্নয়ন করা না গেলে সমগ্র দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হবে। আর তাঁর এ ¯^cœ বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের পাশে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জানতেন তাঁর একার পক্ষে সমগ্র দেশকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তাই তাঁর সরল ¯^xKv†ivw³ ও আকাঙ্ক্ষা , “ আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোট গ্রাম। ... আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরী হবে।”(শ্রী নিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ , রর , চতুর্দশ খন্ড, পৃ ৩৮০)

তিনি দেশের মানুষের প্রতি ¯^‡`k প্রেমে উদ্ভুদ্ধ হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। “ দেশে জম্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি-ততক্ষণ সেদেশ আপনার নয়।”(দেশের কাজ, রর , ত্রয়োদশ খন্ড, পৃ ৫২৬)
তিনি দেশের গরিব মানুষদের সন্মান দেয়ার এবং তাদেরকে আপন শক্তিতে বলিয়ান করার জন্য উৎসাহ প্রদান করার আহ্বান জানিয়েছেন। “আমাদের দুঃখের লক্ষণগুলিকে বাহির হইতে দূর করা যাইবে না, দুঃখের কারণগুলিকে ভেতর হইতে দূর করিতে হইবে। তাহা যদি করিতে চাই তবে দুটি কাজ আছে। এক, দেশের সর্বসাধারণকে শিক্ষা দিয়া পৃথিবীর সকল মানুষের মনের সঙ্গে তাহাদের মনের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া-বিশ্ব হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া তাহাদের মনটা গ্রাম্য এবং একঘরে হইয়া আছে, তাহাদিগকে বড় মানুষ করিতে হইবে-আর-এক, জীবিকার ক্ষেত্রে তাহাদিগকে পরস্পর মিলাইয়া পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে তাহাদের কাজের যোগ ঘটাইয়া দেওয়া’।”(সমবায়-১, রর, চতুর্দশ খন্ড, পৃ. ৩১৬)।

তিনি বিদেশী সহায়তার প্রতি বেশি নির্ভরশীল না হয়ে নিজের দেশের সম্পদ ও সম্মিলিত শক্তির উপর জোর দিয়েছিলেন । “ বিদেশী চিরদিন আমাদের ¯^‡`k‡K অন্নজল ও বিদ্যা ভিক্ষা দিবে, আমাদের কর্তব্য কেবল এই যে, ভিক্ষার অংশ মনের মত না হইলেই আমরা চিৎকার করিতে থাকিব? কদাচ নহে, কদাচ নহে! ¯^‡`‡ki ভাব আমরা প্রত্যেকেই এর প্রতিদিনই গ্রহণ করিব-তাহাতে আমাদের গৌরব.আমাদের ধর্ম ।”(আত্মশক্তি, রর , দ্বিতীয় খন্ড, পৃ ৬৩৩)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক মহান মানুষটি শুধুমাত্র লেখনীর মাধ্যমে নিজেকে সমাজ চিন্তাবিদ হিসাবে গড়ে তোলেননি বরং বিভিন্ন সময়ে নিজের কাজে কর্মে তার ¯^cœ¸‡jv, চিন্তাগুলো সফল করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশে তিনিই সর্বপ্রথম কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন, সেই ১৯০৫ সালে, পতিসরে। রবীন্দ্রনাথের জমিদারির অন্যতম এলাকা ছিল  কালিগ্রাম পরগনা, অর্থাৎ পতিসর, যেখানকার ৮০ ভাগ প্রজা ছিল মুসলমান এবং গরীব কৃষক ও তাঁতী। ফসল ফলানো ও জীবন ধারণের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে তাদের চড়া সুদে ঋণ নিতে হতো, ফলে নিজেদের জীবনের মান তারা উন্নত করতে তো পারছিলনা বটেই বরং ঋণের জালে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। প্রজা দরদী রবীন্দ্রনাথ তাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য এগিয়ে এলেন, স্থাপন করলেন কৃষি ব্যাংক। মহাজনদের কাছ থেকে চাষীরা যেখানে মাসে ১০ টাকা সুদ হারে ঋণ নিত সেখানে কৃষি ব্যাংক থেকে তারা ঋণ নিত বছরে মাত্র ১২ টাকা সুদে। এর ফলে মহাজনরা এক সময় সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত ১২০০০০ টাকা থেকে ১১২০০০ টাকা এই কৃষি ব্যাংকে মূলধন হিসেবে দিয়েছিলেন এবং তাঁর AvZ¥xq-¯^Rb-eÜz-evÜe‡`i‡K এখানে টাকা জমা রাখতেও উৎসাহিত করেছিলেন। এই ব্যাংকের টাকা প্রজাদের কল্যাণ কাজে ব্যতীত অন্য কোন কাজে ব্যবহারে তিনি নিরুৎসাহিত ছিলেন। অবশ্য একাধিকবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানির কারণে কৃষক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রায় ২০ বছর চলার পর একসময়ে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তাছাড়া ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও বিলিতি জিনিস বর্জন আন্দোলনের সময় তিনি দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য কুঠির শিল্পের উন্নয়ন কাজে হাত দিয়েছিলেন। সেসময় তিনি কুষ্টিয়ায় তাঁতের কারখানা স্থাপন করেন। এছাড়া একজন মুসলমান প্রজাকে তাঁতের কাজ শেখানোর জন্য শান্তিনিকেতন পাঠিয়েছিলেন এবং শ্রীরামপুর থেকে নিয়ে এসেছিলেন একজন অভিজ্ঞ তাঁতীকে।  তার তত্ত্বাবধানে কুষ্টিয়ায় দু’টি উইভিং স্কুল স্থাপন করেছিলেন গ্রামের লোকজনকে তাঁতকৌশল শেখানোর জন্য। পটারির কাজেও হাত দেয়া হয়েছিল সেসময়। তিনি সবসময় তাঁর প্রজাদের উন্নয়নের চিন্তায় ভাবিত ছিলেন। তাঁর চিন্তা-কাজের মধ্য দিয়ে তিনি পুত্র, বন্ধুপুত্র, জামাতা, শ্যালকসহ অনেককে cÖfvevwš^Z করতে পেরেছিলেন। পতিসর থেকে পুত্রকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “ বোলপুরে একটা ধানভানা কল চলছে, সেই রকম একটা কল এখানে আনতে পারলে বিশেষ কাজে লাগবে।... এখানকার চাষীদের কোন্‌ industry শেখানো যেতে পারে সেই কথা ভাবছিলুম। এখানে ধান ছাড়া আর কিছু জন্মায় না। এদের থাকবার মধ্যে কেবল শক্ত এঁটেল মাটি আছে। আমি জানতে চাই  Pottery  জিনিসটাকে Cottage industry রূপে গণ্য করা চলে কিনা। একবার খবর নিয়ে দেখিস ছোটখাট furnace আনিয়ে এক গ্রামের লোক মিলে এ কাজ চালানো যায় কিনা। আরেকটা জিনিস আছে ছাতা তৈরি করা শেখানো। সে রকম শেখানোর লোক যদি পাওয়া যায় তাহলে শিলাইদহ অঞ্চলে এ কাজটা চালানো যেতে পারে। নগেন্দ্র (শ্যালক) বলছিল খোলা তৈরি করতে পারে এমন কুমোর এখানে আনতে পারলে বিশেষ উপকার হয়। লোকে টিনের ছাদ দিতে চায় পেরে ওঠে না; খোলা পেলে সুবিধা হয়।”

১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা ও গোষ্ঠবিদ্যার উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে নিজ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষ চন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা ফিরে এসে পল্লীর উন্নয়নে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারেন।  পরের বছর, ১৯০৭ সালে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও কৃষিবিদ্যার উপর উচ্চতর ডিগ্রি নিতে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। তিনি জামাতেকে চিঠিতে লিখছেন, “রথীর কাজে তুমি যদি সহযোগী হতে চাও তাহলে ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে। চাষীদের সঙ্গে co-operation- এ কাজ করা, ব্যাংক করা, এদের ¯^v¯’¨Ki বাসস্থান স্থাপন করা, ঋণমোচন করা, ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বৃদ্ধবয়সের সংস্থান করে দেয়া, রাস্তা করা, বাঁধ বেঁধে দেয়া, জলকষ্ট দূর করা, পরস্পরকে পরস্পরের সহায়তাসূত্রে আবদ্ধ করা। এমন কত কাজ আছে তার সীমা নেই।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পল্লীপ্রকৃতি, বিশ্বভারতী, কলকাতা ১৯৬২)।
১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথরা বিদেশ থেকে ফিরে শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ, সার, বীজ, সেচ ইত্যাদির কাজ। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন ৮০ বিঘা খাস জমিতে শুরু হয় সুদূর ভবিষ্যৎমুখী আধুনিক কৃষি খামার। আমেরিকা থেকে আমদানী করা হলো ভুট্টার বীজ, গৃহপালিত পশুর খাবারের জন্য নানাবিধ ঘাসের বীজ, নৈনিতালের আলুও আনা হয়েছিল সেসময়। এদেশের উপযোগী করে লাঙল, ফলা ও কৃষির অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরি করা হল। সেই সময়ে, ১৯১০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আনা হয়েছিল ট্রাক্টর, রবীন্দ্র পুত্র রথী তা চালিয়ে কৃষকদের চাষাবাদ পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন। জমিতে ব্যবহার করা হয়েছিল আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি কম্পোস্ট ও জৈবসার। নৌকা বোঝায় করে নষ্ট ইলিস এনে চুন মিশিয়ে মাটিতে পুঁতে জৈবসার তৈরি করা হয়েছিল। মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা ও অধিক ফলনের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল ছোট ল্যাবরেটরি। এ আজ যে পন্থায় সারা উপমহাদেশে চাষাবাদ করা হয় রবীন্দ্রনাথ তার গোড়াপত্ত্বন করেন আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে। রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের বৃক্ষরোপনেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বাস্তুবাড়ি, ক্ষেতের আইল ইত্যাদি স্থানে ফলজ বৃক্ষ লাগাতে এবং আলু চাষে উৎসাহিত করতেন। তিনি রেশম চাষেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ স্থানীয় উন্নয়নে প্রজাদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন। আজকে আমরা যে অংশীদারি ভিত্তিক উন্নয়নের কথা বলি তা তিনি তাঁর সময়েই শুরু করেছিলেন। তিনি চাইতেন প্রজারা নিজেদের কাজ নিজেরা করুক, কারো দয়া-দাক্ষিন্যের দিকে তারা যেন তাকিয়ে না থাকে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবে এই শর্তে তিনি কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ পর্যন্ত ৬ মাইল রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কুয়ো বাঁধানো, পুকুর তৈরি ইত্যাদি কাজও চলতো একই নিয়মে। হেলথ কোঅপারেটিভ’র মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থাও সারা ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথই প্রথম করেছিলেন। তিনি স্থাপন করেছিলেন ’মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়’। তিনি নিজেও আবার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছিলেন এবং প্রজাদের চিকিৎসাও করতেন। তিনি পতিসরে বড় হাসপাতালও তৈরি করেছিলেন। চালু করেছিলেন প্রজাদের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা, তাঁর আমলে কোন বিবাদ নিয়ে প্রজারা সরকারী আদালতে যেত না, নিজেদের বিচারালয়ে সমস্যার সমাধান করতো।
তিনি পল্লী সংগঠন গঠনের উপর জোর দিতেন বেশি। পল্লী সংগঠনের প্রথম পর্যায়েই রবীন্দ্রনাথ চালু করেন হিতৈষীবৃত্তি ও কল্যাণবৃত্তি। প্রজাদের খাজনা আর জমিদারির সেরেস্তা থেকে সংগৃহিত টাকার একটা অংশ দিয়ে এই দু’টি তহবিল গঠন করা হয়েছিল। সেই বাবদ সংগৃহীত সকল টাকা ব্যয় হতো জমি ও প্রজাদের উন্নয়নে, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদ সংস্কার, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন আর প্রজাদের বিপদ-আপদের সাহায্যে।
জমিদারি করতে এসে রবীন্দ্রনাথ যেন নিজেকে অন্যরূপে আবিস্কার করেছিলেন। ¯^‡`k ও প্রজাদের উন্নয়নের জন্য তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা তাঁকে এক অনন্য মহামানবের চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। প্রাচ্যের অসামপ্রদায়িক ও অবর্ণবাদী এই মনীষী তাঁর সমাজ চিন্তার মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বের অন্যান্য বড় বড় কবি-সাহিত্যিকদের চেয়ে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছেন। নিজের দেশ ও জাতিকে এমন গভীর মমতায় ভালবাসতে পারে খুব কম লোকই। শত বছর আগে তিনি যে পথ দেখিয়ে গেছেন, বর্তমান বাস্তবতার আলোকে সেই পথ যেন আমাদের আজো ডাকছে। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নাটক m¤^‡Ü আমাদের নতুন প্রজন্মদের যেমন জানানো উচিত তেমনি তাঁর সমাজ চিন্তাগুলোকেও আরো ভালভাবে প্রচার করা বড়ই প্রয়োজন, এতে করে এ জাতি আরো বলিষ্ঠ হবে, উদ্দিপ্ত হবে, দেশের কাজে নিজেদের আন্তরিকভাবে উজার করে দিবে। রবীন্দ্রনাথের সৃষিটগুলো অমর, আমাদেরকে বারবার তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।

তথ্যসূত্র

  1. রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ, দশম, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ খন্ড।
  2. রহমান, আতিউর (২০০০)   : রবীন্দ্র-অমর্ত্য ভাবনা : মানুষের জন্য উন্নয়ন, ইউপিএল, ঢাকা।
  3. রহমান, আতিউর (২০০৮)  : রবীন্দ্র ভাবনায় সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা।
  4. মুরশিদ, গোলাম (১৯৯৩)   : রবীন্দ্র বিশ্বে পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র চর্চা, বাঙলা একাডেমৗ, ঢাকা।
  5. আহমদ, রফিক (১৯৯৮)    : রবীন্দ্র ভূবনে পতিসর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।
  6. শাকুর, আবদুশ (মে, ২০১১) : রবীন্দ্রনাথের গ্রাম ভাবনা, বিডিনিউজ২৪.কম।

Comments